শিল্পী নাগ: শাহীনা আমীন (পিপিএম)। বাংলাদেশ আর্মড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল কাজের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে পেশা হিসাবে এমন কাজ বেছে নেবেন। তার মনে এ স্বপ্ন বোনার পেছনে বাবা একেএম নুরুল আমীন এবং মা মুজিয়াতুন নেছার অনুপ্রেরণা ছিল। কারণ বাবা চাইতেন তার মেয়েরা এ্যারো নটিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। ছোটবেলায় বাবার এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা তার চিন্তাধারায়ও পরিবর্তন আনে। চ্যালেঞ্জিং কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হন। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা থেকেই বিসিএসের মাধ্যমে ২০০১ সালের ৩১ মে সার্কেল এসপি পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন।
শাহীনা আমীনের প্রথম কর্মস্থল ছিল জামালপুর। ছোট বাচ্চা রেখে কাজে যোগদান করে তিনি দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। কঠিন কাজগুলোকে তিনি সহজভাবে গ্রহণ করেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আর্মড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক শাহীনা আমীন পিপিএম কর্মজীবনের প্রথম অভিজ্ঞতার কথা বলেন, ‘প্রথম দিকে কাজ করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। যখন কাজে যোগদান করি আমার বাচ্চা খুব ছোট ছিল। স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায়। সদর সার্কেল এসপির কাজগুলো ছিল তদন্ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সবকিছুর সমন্বয়। অর্থাৎ সার্কেল এসপি মানেই সুপারভাইজার। আমার নিয়ন্ত্রণাধীন থানাগুলো ছিল প্রত্যন্ত এলাকাতে। কোনো সেনসেটিভ কেস থাকলে পুরোনো আমলের গাড়ি নিয়েই আমাদের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেতে হতো। আমাকে দেখলেই মানুষজন ঘিরে ধরতো। স্থানীয় লোকজন জিজ্ঞেস করতেন, ‘উনি কেন এসেছেন। কী বিষয়। কারণ নারী পুলিশ কর্মকর্তা তারা কখনো চোখেই দেখেননি। সেখানে গিয়ে সত্যিকারের, সঠিক তথ্য তুলে আনতাম। সিনিয়র-জুনিয়র সব সহকর্মীর কাছে সহযোগিতা পেয়েছি। দিনে এ কাজগুলো করতাম। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় মন খারাপ হতো। কিন্তু কাজের চাপে তা ভুলে দিনরাত কাজ করতে হতো। সন্ধ্যার পর অফিসিয়াল ডেস্ক জব রেজিস্টার দেখা, বিভিন্ন কাগজপত্র আপডেট করা ছাড়াও ডকুমেন্টারি কাজগুলো করতাম। কারণ আমি মনে করতাম কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের কাছে আমাকে আইডল হতে হবে। তাহলে তারা আমার আদেশ, নির্দেশ মানবে। আমি যদি আমার কাজের মধ্য দিয়ে তাদের সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি তাহলে তারা আমাকে এক সময় অনুসরণ করবেন। আমি যদি তাদের সামনে আদর্শ স্থাপন করতে না পারি তাহলে তারা আমার নির্দেশ-আদেশ মেনে চলবেন না। সরকারি দায়িত্ব, দেশের প্রতি আনুগত্য থেকেই নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছি। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছি। যখন যে কাজ এসেছে দ্বিধাহীনভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।’
জাতিসংঘের দুটি মিশনে অংশ নেন শাহীনা আমীন। দুই হাজার আট সালে ইউরোপের একটি দেশ কসোভোতে যান। তখন তিনি অতিরিক্ত এসপি পদে কর্মরত ছিলেন। এখানে সার্ভিও ও কোরশীয়দের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। এটা নিয়ে অশান্তি বিরাজমান ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিরোধী দল মারামারি করছে সেখানে আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গেছি। বিরোধী দলের ছোড়া ইট-পাটকেলে আমরাও আহত হতাম। এই চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখেই কাজ করতাম।’
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর হয়ে ২০১২ সালে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দেশ হাইতিতে যান। তিনি প্রত্যক্ষ করেন, সেখানকার নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। অনেক ক্ষেত্রে সে সময়ে আমাদের নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চেয়েও খারাপ। ওদের সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। পরিমিত খাবার পায় না। পারিবারিক সহিংসতা, যৌন সহিংসতা শিকার হয় মেয়েরা। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে।
দায়িত্ব কর্মপ্রণালী ও অভিজ্ঞতা নিয়ে শাহীনা আমীন বলেন, ‘আমাদের কাজ ছিল নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। জাতিগতভাবে কোনো সমস্যা তৈরি না হয় তা পর্যবেক্ষণ করা। আমি নিজে একজন নারী বলে নারীদের বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে দেখতাম। চেষ্টা করতাম তাদের সহযোগিতা করার জন্য। আমাদের কন্টিনজেন্টের ভেতর থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী সোশ্যাল কাউন্সেলিং করতাম। আমাদের মূল কাজ ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। এর বাইরেও এ কাজগুলো গুরুত্বসহকারে করতাম। ওখানে একটা উইমেন ফোরাম ছিল। উইমেন ফোরামের থেকেও আমরা এ কাজগুলো করেছি। একদিন ডিউটিতে আইডিপি ক্যাম্পে যাই। তখন একজন মা তার অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ান। আমাকে ইশারায় বোঝাতে চাইছিলেন বাচ্চাগুলোসহ তিনি কয়েকদিন ধরে অনাহারে রয়েছেন। আমি আমার গাড়িতে রাখা খাবারের প্যাকেট এনে তাদের হাতে দিই। অশ্রুসিক্ত চোখে ওই মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রেয়ল ভাষায় আর্শীবাদ করলেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম, দেশ-জাতি-সীমানা ছাড়িয়ে সব নারী, মায়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা এক।’
বাংলাদেশ পুলিশে মেয়েদের যোগদান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পুলিশে মেয়েদের কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই মেয়েদের এ পেশায় বেশি বেশি আসা দরকার। পুলিশে অনেক সংখ্যক নারী কর্মকর্তা এলে আমাদের আর্থসামাজিক ও নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী পুলিশ বিশাল ভূমিকা পালন করবে।’
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আইজিপি গুড সার্ভিস পুরস্কার, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক ইত্যাদি।
অস্ট্রেলিয়াতে এক্সিকিউটিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগামে ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এক মাসের প্রশিক্ষণ, জর্ডানে ২০০৬ সালে কনফারেন্স অন ডমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যান্ড ফ্যামিলি প্রোটেকশন বিষয়ক সেমিনার, ২০১৫ সালে ভারতের হায়দরাবাদে সাউথ এশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল উইমেন পুলিশ কনফারেন্স, ২০১৭ সালে ইতালিতে ভিসেনজায় ২১ দিনের ‘জেন্ডারবিষয়ক কোর্স’, ২০১৮ সালে আমেরিকার আলেক্সাতে সাত দিনের ইন্টারন্যাশনাল উইমেন পুলিশ কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন।