অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী: আমি শিক্ষা ও গবেষণা প্রিয় একজন মানুষ | আমি সব সময় চাই চোখের সামনে আমার ছাত্ররা থাকবে | নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আমি তাদের কাছ থেকে শিখবো ও আমার যতটুকু সাধ্য আছে সে সাধ্যের মধ্যে থেকে আমি তাদের শিখাবো । জীবনমুখী বাস্তব শিক্ষার প্রভাব এভাবে একসময় বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে | সবচেয়ে বড় কথা, আমি আমার ছাত্রদের সাথে নিয়ে মৌলিক ও ফলিত গবেষণায় নিজেকে খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত করতে চাই | আমি সব সময় বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের ছাত্রদের সাথে নিয়ে গবেষণার স্বপ্নকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে চাই | গবেষণা করার সময় ছাত্ররা তাকে ঘিরে থাকতো | ছাত্রদের গবেষণা শিখাবেন বলে বিয়ে করে সংসার পর্যন্ত করেননি তিনি | খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ ছিলেন | ছাত্রদের গবেষণা শিখাতে শিখাতে এক প্রিয় ছাত্রের বুকে মাথা রেখে কখন এ মৃত্যুর কোলে ঢলে তা কেউ বুঝতেও পারেনি | এমন ভাগ্য নিয়ে আমরা জন্মেছি কীনা জানিনা তবে এমন ভাগ্য নিয়ে যেন আমাদের শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষকরা জন্ম নেন | আরেকজন ছাত্র বান্ধব শিক্ষকের কথা মনে পড়ছে | আমাদের জাতীয় বীর তিনি | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক শহীদ শামসুজ্জোহা স্যার |
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্বে থাকাকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা গিয়ে তিনি প্রাণ দেন | প্রাণের ছাত্রদের আগলে রেখে তিনি নিজের বুক পেতে পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে চিৎকার করে বলেন, “আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে। সাহসী মানুষটি কথাগুলো বলে পিছুপা হলেননা | কারণ এগুলো কথার কথা ছিলোনা বরং অন্তর দিয়ে ভালোবাসার মুখগুলিকে আঁকড়ে ধরার আকুতি ছিল | গুলি চালালো পাকিস্তানি হানাদারেরা | ছাত্রদের নিরাপদ রাখতে বুক উঁচিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। রক্ত ঝরলো মাটিতে | শহীদের রক্ত | নিভে গেলো আলোকিত একজন মানুষের জীবন | নিজের জীবন তুচ্ছ ভেবেছেন সন্তানতুল্য ছাত্রদের জন্য | এমন শিক্ষক কী এখন আর আছে | যিনি পরিবারের কথা ভাবেননি | নিজের স্বার্থের কথা ভাবেননি | সব সময় ভেবেছেন ছাত্রদের কল্যাণের কথা | মৃত্যু মানুষটির প্রাণ কেড়ে নিলেও, কেড়ে নিতে পারেনি তার কালজয়ী সত্তাকে | ইতিহাস এই মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষটিকে গড়েনি বরং তিনিই ইতিহাসকে গড়েছেন |
মমতাময়ী মাও তো একজন শিক্ষক | সেটা আমরা হয়তো বুঝতে পারিনা | তবে সময় আমাদের তা বুঝিয়ে দেয় | একটা ঘটনায় বিষয়টি অনেক সহজবোধ্য হয়ে যাবে | বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। এক দিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে খামবন্দি চিঠি দিলেন। তিনি মাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন এবং তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। এক দিন তাঁর পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল—‘আপনার সন্তান মেধাহীন ও নিম্ন বুদ্ধিসম্পন্ন। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং তার চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে ভেবেছেন কীভাবে একটা নেতিবাচক ধারণাকে ইতিবাচক ধারণায় পরিণত করা যায়। তিনি টমাস আলভা এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে যেতে দেননি বরং তার মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন যে তার মতো মেধাবী পৃথিবীতে আর কেউ নেই | কয়েকটি শব্দের ইতিবাচক পরিবর্তন এডিসনের জীবন পাল্টে দিয়েছিল। এখানে এডিসনের মা একজন শিক্ষকের মতো কাজ করেছেন। কিন্তু তা স্কুলের শিক্ষকরা তা পারেননি।
প্রতিদিন এমন নিঃস্বার্থ শিক্ষকদের খুঁজি | সেই প্রানপ্রিয় মুখগুলিকে খুঁজি | কিন্তু কোথায় তারা | তারা তো আকাশের তারা হয়ে গেছে | সে তারা এখনও রাতে আলোর মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে | আমাদের আলোকিত পথ দেখানোর অপেক্ষা করে | কিন্তু আমরা তো স্বার্থপর হয়ে গেছি | সবাই আর শিক্ষক নেই, কেউ কেউ শিক্ষক | এক দুষ্টচক্রে বাধা পড়ে গেছে শিক্ষকদের প্রকৃত সত্তা | শিক্ষকতা পেশা নয়, এটা একটা আত্মত্যাগ | এটা একটা সেবা | কিন্তু কে শুনবে কার কথা | ছাত্রদের মুখগুলো দেখে কষ্ট লাগে | ওরা ওদের প্রতিভার আলো ছড়িয়ে আলোকিত হতে চায় | কিন্তু শিক্ষক নামের সেই নিঃস্বার্থ মানুষটা তো আর নেই | সব যেন দুঃস্বপ্ন, সব যেন গন্তব্যহীন |