খাদিজা খানম তাহমিনা : কিশোরগঞ্জের মেয়ে মৌসুমা রাহা। আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।বাকি সবার মত এই লকডাউনে যখন মার্চের ১৮ তারিখে বাড়ি আসেন, ছোট ভাইয়ের আবদার, তাকে কেক বানিয়ে খাওয়াতে হবে। কিন্তু তখনও তিনি কেক বানাতে পারেন না ঠিকমতো। প্রথম ২০১৭ তে একবার হোস্টেলে কেক বানিয়ে ছিলেন। তারপর আবার এই ২০২০ এ বানাতে গেলেন ছোট ভাইয়ের আবদার পূরণের জন্য। কোনোভাবেই আর কেক হচ্ছিল না। তখন তিনি একটার পর একটা বানিয়েই যাচ্ছিলপন। সবাই হাসাহাসি করতো, এত্ত কেক কেনো বানাচ্ছেন এবং বলেছিল, 'বাসার কেক গুলো এমনই হয়, কোনো রকম। দোকানের মত সুন্দর হয় না।'
নানা জনের নানান কথা শুনেও, ছোট ভাইকে একটা পারফেক্ট কেক খাওয়ানোর ইচ্ছাটা মন থেকে বাদ দিতে পারছিলেন না। চেষ্টা করতে করতে গিয়ে একটা কেক পারফেক্ট হয়েছে। আর সেই কেক মাদার্স ডে উপলক্ষে কাটা হয়েছিল, সেদিন সবাই কেক পছন্দ করেছে আর বলেছিল 'দোকানের থেকেও ভালো হয়েছে।'
ভাবির অনুপ্রেরণায় শুরু করেন কেক তৈরি। ভাবি বললেন, চেষ্টা করতে থাকো। তখন একের পর এক চেষ্টার পর নিকটজনদের জন্মদিনে কেক বানানো দায়িত্ব নেন। সবাই অবাক হয়ে যায় মৌসুমা রাহার কেকের চমৎকার ডিজাইন দেখে। তিনি বলেন 'তারপর থেকে পারফেক্ট কেক বানানোর জন্য এক দিনে ৬ থেকে ৭ টা কেক ও বানিয়েছি, বিভিন্ন উপায়ে। বিভিন্নভাবে এক্সপেরিমেন্ট করে করে কেক বানাতাম, নেশার মতো হয়ে গেলো।
এপ্রিলের ২৬ তারিখে গ্রুপ খুলে ফেলেন, যারা কেক বানাতে পারেনা তারা যেনো একজন অপরজন থেকে শিখতে পারেন। গ্রুপের নাম "It’s Delicious". এই ক'দিনে গ্রুপে প্রায় ৮৯০০ জন মেম্বার হয়ে গেছে।
উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখেছেন, উই গ্রুপে জয়েন হবার পর। ভাবির মাধ্যমে উই জয়েন হোন মে মাসের ২৯ তারিখ। ননদ ভাবি মিলে কিছু একটা করবেন, তাই ভাবতে থাকেন।। তখন কিছু কেক বানান, উই এ আপলোড দেয়ার পর অনেক সাপোর্ট পান। উই এ বলা হয় "যাকে চিনি তার কাছ থেকেই কিনি।"
মৌসুমা রাহা বলেন, আমার প্রথম কাস্টমার ছিলেন মিতাশা আপু। তিনি কেক খেয়ে জানালেন, কেক তো মাশাল্লাহ অনেক মজা। সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। সেদিন মনে হচ্ছিল, এত্ত কষ্ট স্বার্থক হয়েছে। আপুর সুন্দর একটি রিভিউ দেখেই অনেকে অর্ডার করেন। আর সেই থেকে আমার কাস্টমার সংখ্যা ১৮৫+ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
উই গ্রুপে রীতিমত সময় দিয়ে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ট্রেনিং ক্লাসে জয়েন থেকে অনেক কিছু শিখছেন। নিজেও রাত দিন পরিশ্রম করে কেক বানিয়ে যাচ্ছেন।
'কিন্তু এত্ত অল্পদিনে এত্ত কিছু সম্ভব?' প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা চোখের সামনে ছিল, শুধু তারাই বলতে পারবেন।
এখন আমি কেক নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে যাচ্ছি। ইচ্ছা আছে এটা নিয়ে অনেক দূর যাবার। শিখতে গিয়ে ঠিক কতটা কষ্ট হয়েছে, তা তো লিখে বুঝানো সম্ভব না।
সব কাজেই কষ্ট আছে, সবার জীবনে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। আমি শুধু এত টুকুই বলতে পারি, অসম্ভব বলে কিছু নেই। চাইলেই সবাই সব কিছু করতে পারে। শুধু একটা কাজের পেছনে অনেক সময় পরিশ্রম ব্যয় করতে হয়।
মৌসুমা রাহা জানান, তার বাসায় এসব বিজনেস বা উদ্যোক্তা কোনোটাই পছন্দ করেনা, কিন্তু ভাবি তাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন এবং তার কাজে অনেক সাহায্য করে যাচ্ছেন । এখন সবাই তাকে সাপোর্ট করছেন, ডেলিভারি নিয়ে ঝামেলা হলে, তার ভাই সাহায্য করছেন।
এখন অবধি শুধু উই এ প্রায় ১ লক্ষ ৭ হাজার ৮৫ টাকা সেল করতে পেরেছেন। তাছাড়াও অফলাইনে অনেক সাড়া পেয়েছেন।
মৌসুমা রাহা মনে করেন, শুরুর দিকটা সবার জন্যই খুব কষ্টের থাকে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়। শুধু একটা কাজে লেগে থাকতে হয়। কাজকে ভালবাসলে, কাজও ভালবাসা দিতে বাধ্য।
এখন তার সময় কাজের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই উদ্যোগকে আরো বড় করতে পারব। আমি যেহেতু কিশোরগঞ্জের মেয়ে, তাই ইচ্ছা আছে নিজের এলাকায় বেকিং নিয়ে গ্রামে গ্রামে উদ্যোক্তা বানানোর। তাহলে ওনারা ঘরে বসেই টাকা ইনকাম করতে পারবে।
লাখপতি মৌসুমা রাহার সাথে কথা বলেছেন, উইমেন আই টুয়েন্টি ফোর ডটকম এর প্রতিনিধি খাদিজা খানম তাহমিনা,...
★. উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনের গল্পটা বলেন। উদ্যোক্তা জীবনের শুরুটা কিভাবে?
মৌসুমা রাহা : উই গ্রুপে জয়েন হবার পর, যখন দেখলাম সবাই ঘরে বসেই নানান ধরনের কাজ করছে, তখন আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু করার।
★ কেনো মনে হলো, আপনি উদ্যোক্তা হবেন?
মৌসুমা রাহাঃ আমার কারোর অধীনে কাজ করার থেকে নিজে কিছু করাটা বেশি ভালো লাগে।
★ আপনার লাখপতি হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।
মৌসুমা রাহা : আমার সেল শুরু হয় জুনের ১৫ তারিখ থেকে, আমি উই এ এক্টিভ থাকি আর কাজের প্রতি ভালবাসা রেখে তা চালিয়ে যাই। আলহামদুলিল্লাহ প্রথম দিকে সেল মোটামুটি হলেও এই অক্টোবর এর শেষ দিকে তা এক লক্ষ তে পৌঁছে যায়। আর এর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, দিন কে রাত এবং রাত কে দিন।
★ কতদিনে লাখপতি হলেন?
মৌসুমা রাহা : পাঁচ মাস সময় লেগেছে আমার লাখপতি হতে। আসলে ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম থাকলে কোনো কাজে সফল হতে তেমন বেশি সময় লাগে না, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি নিজে।
★ আপনার ব্যবসা পদ্ধতি কি?
মৌসুমা রাহা : আপাতত অনলাইন বেইস।
★ শুরুর চ্যালেন্জগুলো কি কি ছিল (বিনিয়োগ, সহযোগিতা ইত্যাদি) কিভাবে মোকাবেলা করেছেন?
মৌসুমা রাহা : শুরুর দিকে আমার পরিবার তেমন রাজি ছিল না। আমার ভাবি নিজ থেকে উৎসাহ প্রদান করায় সাহস করতে পেরেছিলাম।
★ আপনার সফলতার পেছনে কোনটার প্রভাব ছিলো?
মৌসুমা রাহা : আল্লাহর অশেষ রহমত এবং উই এ এক্টিভ থাকার ফলাফল।
★. উদ্যোক্তা হতে গিয়ে কি কোন ধরনের ট্রেনিং নিয়েছিলেন? এই ট্রেনিংগুলোতে কি কোনোরকম ফি দিতে হয় বা সেই প্রসিডিওরটা কি বা কেমন?
মৌসুমা রাহা : না কোনো ট্রেনিং নেইনি। তবে এখন উই থেকে যে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়, সেগুলো করার চেষ্টা করি।
★আজকে আপনি যতখানি সফল তার পিছনে উল্লেখযোগ্য কারনগুলো কি?
মৌসুমা রাহা : অদম্য সাহস, আর কঠোর পরিশ্রমের ফলাফল।
★.উদ্যোক্তা হওয়াটা কতটা সহজ মনে হয় আপনার কাছে, বা একজন নারীর উদ্যোক্তা হতে কি কি গুণাবলী বা যোগ্যতার প্রয়োজন হয় বলে আপনি মনে করেন?
মৌসুমা রাহা : উদ্যোক্তা হওয়া আসলে মুখে বলা যত টা সহজ, করাটা অনেক বেশি কঠিন মনে হলো। কারণ এখানে কোনো কিছু রেডি থাকে না, সম্পূর্ণ কাজ নিজেকে করতে হয়। অনেক গুলো ব্যাপার মাথায় রাখতে হয়।
★. অনলাইনে ব্যবসা তা-ও আবার ফুড আইটেম, সম্ভাবনা কেমন?
মৌসুমা রাহা : আলহামদুলিল্লাহ অনলাইনে খাবারের অনেক চাহিদা রয়েছে। সবাই হোমমেইড খাবারটা নিঃসন্দেহে তার পরিবারের জন্য নিতে চান। মার্কেটের উপর ভরসা করতে পারেন না অনেকেই।
★. আপনার কাজ নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কি?
মৌসুমা রাহা : আমার ইচ্ছা আছে নিজের একটা রেস্টুরেন্ট দেয়ার।
আল্লাহ চাইলে হবে, আমি পরিশ্রম করে যাবো ইনশাআল্লাহ।
★. উদ্যোক্তাদের সফলতার সাথে সাথে যে বিষয়গুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তার মধ্যে উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন অন্যতম। আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টি কি?
মৌসুমা রাহা : আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়, আমিও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আর নিজেকে স্ট্রং রেখেছি সকল কিছুর সামনে, নিজেকে নিজেই স্বান্তনা দিয়েছি অনেক ক্ষেত্রে।
★. আপনার পরিবার সম্পর্কে বলেন।
মৌসুমা রাহা : আমার পরিবার কিশোরগঞ্জ থাকে। বাবা-মা, দুই ভাই, ভাবি এবং ভাতিজি নিয়ে আমার পরিবার। আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছি।
★ আপনার পড়াশোনা...
মৌসুমা রাহা : আমি আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।
★ উদ্যোক্তা হতে গিয়ে এমন কোন কষ্ট পেয়েছেন, যা আপনাকে এখনও কষ্ট দেয়?
মৌসুমা রাহা : উদ্যোক্তাদের অনেক ক্ষেত্রে ছোট করে দেখা হয়, সেই ব্যাপারটা খারাপ লাগে।
★ যে সাফল্যের কথা আপনি সবাইকে বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন.....
মৌসুমা রাহা : উদ্যোক্তা হবার পর সত্যিই নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। কেনো মনে হয় জানি না।
কিন্তু নিজের একটা পরিচিতি পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ, এটাই অনেক।
★ নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শুরু করতে বিনিয়োগ কতখানি সমস্যা বলে আপনি মনে করেন?
মৌসুমা রাহা : বিনিয়োগটা আসলে সবার ক্ষেত্রে এক নয়, যদি ফুড নিয়ে ভাবেন, তাহলে খুবই অল্প বিনিয়োগে শুরু করতে পারবেন ব্যবসা।
★ নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য কি বলতে চান..?
মৌসুমা রাহা : একটা কথাই বলব, হুটহাট একে ওকে দেখে যেনো উদ্যোক্তা না হতে চান। কারণ উদ্যোক্তা হবার জন্য অনেক পরিশ্রম, ধৈর্যের দরকার। একটা কাজ শুরু করলাম, আবার মন চাইলো বাদ দিলাম- এমন করলে অন্য যারা উদ্যোক্তা হতে চাইছেন, উনারা আগেই নিরাশ হবেন। তাই আমার মতে খুব ভেবে পা বাড়ানোটাই উচিত।